বনি ইসরাল ও হজরত মুসা আ. এর কাহিনি আমাদের সবারই কম বেশি জানা। মিশরে ফেরাউনের নেতৃত্বে যখন বছরের পর বছর তাদের উপর চলছিলো অত্যাচার ঠিক তখন আল্লাহ পাঠিয়েছিলেন হজরত মুসা (আঃ) কে তাদের পথ দেখানর জন্য । আমরা জানি আল্লাহ কীভাবে ফেরাউনের ঘরে রেখেই মুসা (আঃ) কে লালন পালন করেছিলেন। এবং কীভাবে মুসা (আঃ) এর মাধ্যমেই ফেরাউনের কাছ থেকে বনি ইসরাইলকে রক্ষা করেছিলো। একমাত্র তারা পেয়েছিলো একই সাথে দুইজন নবী। এর আগেও অনেক জাতি দুজন নবী পেলেও একসাথে তারা দাওয়াত দিয়েছে বা একই সাথে নবুওয়ত পেয়েছে এমনটা জানা যায়নি।কিন্তু বনি ইসরাইল বিনিময়ে কী করেছিলো? আমরা আজ সেই বিষয়গুলোই সম্পূর্ণ কল্প কাহিনি বিবর্জিত পবিত্র কুরআনের আলোকে আলোচনা করবো।
প্রথম দাবি
লোহিত সাগর পার হয়ে যখন তারা আনন্দ ও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছিলো তখন মুসা (আঃ) তাদের একত্রিত করে আল্লাহর কথা মত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে বললেন, সেই মুহুর্তেই তারা তাদের প্রথম অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বসে।
এই ঘটনা কুরআন মাজিদে বর্ণিত হয়েছে এভাবে–
“আর আমি বনি ইসরাইল কে সমুদ্র পার করিয়ে দিই; তারপর তারা প্রতিমাপূজায় রত এক জাতির কাছে উপস্থিত হয়। (তা দেখে) তারা (বনি ইসরাইলিরা) বললো, “হে মুসা, তাদের দেবতার (প্রতিমাসমূহের) মতো আমাদের জন্যও একটি দেবতা গড়ে দাও।” সে বললো, “তোমরা তো এক মূর্খ সম্প্রদায়। এইসব লোক যাতে লিপ্ত রয়েছে তা তো বিধ্বস্ত হবে এবং তারা যা করছে সেটাও অমূলক।” সে আরও বললো, “আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের জন্য কি আমি অন্য ইলাহ খুঁজবো অথচ তিনি তোমাদেরকে বিশ্বজগতের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন?” [সূরা আ‘রাফ, আয়াত ১৩৮–১৪০]
জাতিগত হীনতা
জাতি হিসেবে প্রায় সাড়ে ৪০০ বছর বনি ইসরাইল ছিলো মিসরীয়দের দাস। প্রজম্মের পর প্রজন্ম তারা অত্যাচারীত হয়েছে। তাছাড়া মিসরীয় রীতিনীতি, ধর্মান্ধতা, মূর্তিপূজার মধ্যে বসবাস করে তাদের অন্তর হয়ে গিয়েছিলো সংকীর্ণ। তাই তারা আল্লাহর রহমতের ভালো দিকটি না দেখে, না বিবেচনা করে তাদের সেই আগের মানসিকতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছিলো বার বার।
জান্নাতি খাবারে অনীহা
কোরআনের আলোকে আমরা জানতে পারি একমাত্র বনি ইসরাইল ই আল্লাহর পক্ষ থেকে বিনা পরিশ্রমে জান্নাতি খাবার, গায়েবি পানি পেতো৷ আল্লাহ তাদের বার বার বলেছিলো তোমরা জান্নাতি খাবার খাও আর নাফরমানি করো না। কিন্তু তারা মুসা আ. কে বললো, হে মুসা আমরা একই রকম খাবার খেতে খেতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছি। তুমি তোমার রবকে আমাদের জন্য ভূমি থেকে খাবার দেয়ার প্রার্থনা করো। প্রসঙ্গটি কোরআনে এসেছে এইভাবেঃ
‘যখন তােমরা বলেছিলে, “হে মুসা, আমরা একই রকম খাদ্য কখনো ধৈর্য ধারণ করবো না। সুতরাং তুমি তোমার প্রতিপালকের কাছে আমাদের জন্য প্রার্থনা করাে, তিনি যেনাে ভূমিজাত দ্রব্য—শাক–সবজি, কাকুড়, গম (বা রসুন) মসুর ও পেঁয়াজ আমাদের জন্য উৎপন্ন করেন। মুসা বললাে, “তোমরা কি উৎকৃষ্টতর বস্তুকে নিকৃষ্টতর বস্তুর সঙ্গে বদল করতে চাও? তবে কোন নগরে অবতরণ করে। তোমরা যা চাও তা ওখানে আছে। তারা লাঞ্ছনা ও দারিদ্র গ্রস্ত হলাে এবং তারা আল্লাহর ক্রোধের পাত্র হলো। তা এজন্য যে, তারা আল্লাহর আয়াতকে অস্বীকার করতাে এবং নবীগণকে অন্যায়ভাবে হত্যা করতাে। অবাধ্যতা ও সীমালঙ্ঘন করার জন্যই তাদের এই পরিণতি হয়েছিল।‘ (সূরা বাকারাঃ৬১)
গো– বৎস পূজা
মুসা (আঃ) যখন তুর পাহারে আল্লাহর নির্দেশে ৪০ দিনের ইতিকাফের জন্য গিয়েছিলেন তখনই এরা শুরু করে দেয় আবার নতুম ফিতনা। তাদের দলেরই একজনের নির্দেশে তারা মিসরীয়দের থেকে প্রাপ্ত স্বর্ণ–গয়না দিয়ে গো–বৎস বানিয়ে সেটার পূজা শুরু করে দেয়৷ হারুন (আঃ) অনেক চেষ্টা করলেও তাদেরকে বিরত রাখতে পারেনি। কোরআনে ঘটনাটি বেশ কয়েক জায়গাতে এসেছে। যেমনঃ
‘আর হারুন তাদের আগেই বলেছিলো,”হে আমার সম্প্রদায়, এটা(গো–বৎস) দ্বারা ত তোমাদেরকে কেবল পরীক্ষায় ফেলা হয়েছে।তোমাদের প্রতিপালক ত দয়াময়;সুতরাং তোমরা আমার অনুসরণ করো এবং আমার আদেশ মেনে চলো।” তারা বলেছিল,”আমাদের কাছে মুসা ফিরে না আসা পর্যন্ত আমরা এর পূজা থেকে কিছুতেই বিরত হবো না।” [সূরা তোয়া–হা,আয়াত ৯০–৯১]
আল্লাহকে দেখার আবদার
তুর পাহাড় থেকে তাওরাত নিয়ে ফিরে আসলে মুসা (আঃ) যখন তাদেরকে তাওরাতের উপর ঈমান আনতে বলে তখন তারা বলে বসলো, হে মুসা, আমরা শুধু তোমার কথায় ঈমান আনবো না, যতক্ষণ না আমরা নিজ চোখে আবরণহীন অবস্থায় আল্লাহকে দেখবো। এই ঘটনা থেকেই আমরা বুঝতে পারি এত এত মুযেজা, নিয়ামত পাওয়ার পরেও কতটা অকৃতজ্ঞ হলে এমন আবদার করতে পারে৷
পবিত্র ভূমিতে যেতে অস্বীকার
বছরের পর বছর যখন তারা ঘুরে বেড়াচ্ছিলো তখন আল্লাহ তাদেরকে একটি নির্দিষ্ট পবিত্র ভূমি দেয়ার প্রতিজ্ঞা করেন৷ কিন্তু তার জন্য সামান্য একটি শর্ত ছিলো যে সেই ভূমিতে যারা আছে তাদের সাথে যুদ্ধ করতে হবে। কিন্তু হায়!!! এই অকৃতজ্ঞ জাতি যা বলেছিলো তা খুবই দুঃখজনক। তারা যা বলেছিলো কুরআনে তা স্পষ্ট ভাবে এভাবে বলা আছেঃ
‘তারা বললো, “হে মুসা, তারা যতদিন ওখানে থাকবে ততদিন আমরা ওখানে প্রবেশ করবো না; সুতরাং তুমি এবং তোমার প্রতিপালক যাও এবং যুদ্ধ করো, আমরা এখানেই বসে থাকবো।“‘ (মায়েদাঃ২৪)
গাভী হত্যা
এক যুবক মারা যাবার পর তারা ফিতনা সৃষ্টি করতে চাইলে মুসা (আঃ) ফায়সালার জন্য আল্লাহর নির্দেশে তাদের একটি গাভী জবাই করার নির্দেশ দেন। কিন্তু তারা গাভী নির্বাচন নিয়ে আল্লহর সাথে একের পর এক বেয়াদবি করেছিলো। সূরা বাকারার ৬৭–৭৩ আয়াতে ঘটনাটি এভাবে এসেছেঃ
“স্মরণ করো (সেই সময়ের কথা,) যখন মুসা তার সম্প্রদায়কে বলেছিলো, ” আল্লাহ তোমাদেরকে একটি গরু জবাইয়ের আদেশ দিয়েছেন। ” তারা বলেছিলো, “তুমি কি আমাদের সঙ্গে ঠাট্টা করছো?” মুসা বললো, ” আল্লাহর শরণাপন্ন হচ্ছি, যাতে আমি অজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত না হই।” ( অর্থাৎ, আমি বলছি যে, এটা কোনো বিদ্রুপ নয়।)
তারা বললো, ” আমাদের জন্য তোমার প্রতিপালককে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে বলো তা কীরূপ? ” মুসা বললো, “আল্লাহ বলেছেন, তা এমন গরু যা বৃদ্ধও নয়, অল্পবয়স্কও নয় – মধ্যবয়সী। সুতরাং তোমরা যা আদিষ্ট হয়েছ তা করো।” তারা বললো, “আমাদের জন্য তোমার প্রতিপালককে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে বলো তার রং কী?” মুসা (আঃ) বললেন, “আল্লাহ বলেছেন, তা হলুদ বর্ণের গরু, তার রঙ উজ্জ্বল গাঢ়, যা দর্শকদেরকে আনন্দ দেয়।” তারা বললো, ” আমাদের জন্য তোমার প্রতিপালককে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে বলো তা কোনটি? আমরা গরুটি সম্পর্কে সন্দেহে পতিত হয়েছি এবং আল্লাহ ইচ্ছা করলে নিশ্চয় আমরা দিশা পাবো।“
মুসা (আঃ) বললেন, “তিনি বলেছেন, তা এমন গরু যা জমি–চাষে ও ক্ষেতে পানি সেচের জন্য ব্যবহৃত হয়নি– সুস্থ, নিখুঁত।” তারা বললো, ” এখন তুমি সত্য এনেছো।” যদিও তারা জবাই করতে উদ্যত ছিলো না তবুও তারা ওটাকে জবাই করলো। স্মরণ করো ( সেই সময়ের কথা,) যখন তোমরা এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিলে এবং একে অন্যের প্রতি দোষারোপ করছিলে –তোমরা যা গোপন রাখছিলে আল্লাহ তা ব্যক্ত করছেন। আমি বললাম, ” এর ( জবাইকৃত গরুর) কোনো অংশ দ্বারা ওকে (মৃত ব্যক্তিকে) আঘাত করো। ” ( তাতেই নিহত ব্যক্তি জীবিত হয়ে তার হত্যাকারীর নাম বলে দেবে।) এইভাবে আল্লাহ মৃতকে জীবিত করেন এবং তার নিদর্শন তোমাদেরকে দেখিয়ে থাকেন, যাতে তোমরা অনুধাবন করতে পারো।“
মুসা আ.কে কষ্ট দেয়া
বনি ইসরাইল কে মুক্ত করে আনার পর থেকে তাদের প্রতিটি দাবি, কাজ সব কিছুই মুসা (আঃ) কে কষ্ট দিয়েছে। তাদের একের পর এক অযৌক্তিক দাবি পূরণ করার পরেও তারা মুসা আ. এর উপর নানার অপবাদও দিয়েছেন। এমনকি তার চরিত্রেও দাগ দেয়ার চেষ্টা করেছে তারা। কুরআনে বলা হয়েছেঃ
‘হে মুমিনগণ, মুসাকে যারা কষ্ট দিয়েছে, তোমরা তাদের মত হইয়ো না। তারা যা রটনা করেছিলো, আল্লাহ তা থেকে তাকে নির্দোষ প্রমাণিত করেছিলো, এবং আল্লাহর কাছে সে মর্যাদাবান।‘ (আহযাবঃ৬৯)
উপরোক্ত কাহিনি গুলো একটু মন দিয়ে পড়লেই বুঝতে পারবেন অকৃতজ্ঞতা কাকে বলে। এত এত মুযেজা, নিয়ামতের মাঝেও একটা জাতি কীভাবে এতটা অকৃতজ্ঞ হতে পারে তা আল্লাহই ভালো জানেন। এদের কাহিনি থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়ার অনেক কিছু আছে। আমরাও যেন আল্লাহর এত এত রহমতের মাঝে থেকেও তার নাফরমানি না করি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুক। আমিন।
আশাকরি নিচের লেখাদুটিও আপনাদের ভাল লাগবে।
হযরত হুদ (আঃ), দুর্ধর্ষ আদ জাতি এবং আল্লাহর আযাব।
হযরত উমর (রাঃ)-ইসলামের ইতিহাসের এক সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক
ধন্যবাদ সবাইকে।
Vallagse brother!
thnx 🙄
Nice