ঘুম
ঘুম

 

ঘুম এক প্রশান্তির নাম, এক রহস্যে ঘেরা দ্বীপ, যার উপর আপনার কমই নিয়ন্ত্রন আছে। একজন মানুষ তার জীবনের এক তৃতীয়াংশ সময় ঘুমিয়ে কাটায়। তার মানে আপনি যদি ৮১ বছর বাঁচেন তাহলে বলা যায় আপনি ২৭ বছরই ঘুমিয়েই কাটিয়েছেন। অন্যান্য শারীরিক ব্যায়ামের মতই ঘুমও আপনার জন্য ব্যায়াম, নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম না করলে আপনি হয়ত জীবন পার করে দিতে পারবেন কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণ না ঘুমালে মাত্র কয়েকদিনেই আপনার জীবন হয়ে যেতে পারে দুর্বিষহ। একারনে প্রতিদিনের পর্যাপ্ত ঘুম প্রতিদিনের শারীরিক ব্যায়ামের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্য রক্ষা ও সুস্বাস্থ্যের জন্য তাই শারীরিক ব্যায়াম এবং ব্যালেন্সড ডায়েটের পাশাপাশি পর্যাপ্ত ঘুমও অত্যাবশ্যকীয়।

ঘুম না এলে কি করবেন? নিচের ভিডিও থেকে দেখে নিন।

প্রথমেই জানা যাক ঘুম কেন হয় এবং আমরা কেন জেগে উঠি?

মানব শরীরকে ঘুমানোর জন্য অনেকগুলো ফ্যক্টর কাজ করে। মানব শরীরে একটি ইন্টারনাল ক্লক বা দেহঘড়ি রয়েছে যা নিয়ন্ত্রন করে আমরা কখন ঘুমিয়ে থাকব কিংবা জাগ্রত থাকব। দেহঘড়ি ২৪ ঘন্টার একটি সাইক্লিক অর্ডারে বৃত্তাকারে আবর্তিত হয়।দুইটি ছন্দ দ্বারা এই সাইক্লিক অর্ডার নিয়ন্ত্রিত হয়। প্রথমটি সারাদিন প্রতিটি ঘণ্টায় ঘুমের চাপ তৈরি করে এবং দ্বিতীয়টি সন্ধ্যায় ঘুমের চাপ যখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে থামে তখন আমাদের ঘুমাতে নির্দেশ দেয়।

এডেনোসিন নামের একটি যৌগ ঘুমের সাথে সম্পর্কযুক্ত। আমরা যখন জেগে থাকি তখন এর মাত্রা আমাদের ব্রেইনে পর্যায়ক্রমে বাড়তে থাকে এবং এই বৃদ্ধির মাত্রা আমাদেরকে ঘুমের ইংগিত দেয়। ঘুমানোর সাথে সাথে এটির পরিমাণ আবার কমতে থাকে।

আশেপাশের পরিবেশ, আলো কিংবা অন্ধকার আমাদের দেহঘড়িকে ঘুমাতে কিংবা জেগে থাকতে সিগন্যাল দিয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় চোখ দিয়ে আলোর সংকেত আমাদের মস্তিস্কে পৌছে দিন এবং রাতের পার্থক্য বুঝিয়ে দেয়। এছাড়া, মেলাটোনিন নামক হরমোন দেহঘড়ি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় যা আমাদের দেহকে ঘুমাতে সিগন্যাল দিয়ে থাকে।সন্ধ্যার পরে কৃত্তিম আলো এই প্রক্রিয়াকে ব্যহত করে। সুরয্য উঠার পর আমাদের দেহ করটিসল নামক হরমোন নিঃসরণ করে যা আপনাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলতে সহায়তা করে থাকে।

বয়সের সাথে সাথে আমাদের এই দেহ ঘড়ির পরিবর্তন হয়ে থাকে। একারনেই বিভিন্ন বয়সের মানুষের ঘুমের সময়ের তারতম্য হয়ে থাকে। খেয়াল করে দেখবেন, টীনেজাররা রাতে দেরিতে ঘুমাতে এবং সকালে দেরিতে উঠতে চায়। এর কারণ আর কিছুই না টিনেজ বয়সে মেলাটোনিন ২৪ ঘন্টার দেহ ঘড়িতে দেরিতে নিঃসৃত হয়। অবাক হবার কোন কারণ নেই। শিশু কিংবা অন্যান্য বয়সে এটি ঘটে না বললেই চলে।

পর্যাপ্ত ঘুম আমাদের কেন প্রয়োজন ?

সুস্বাস্থ্যের জন্য পর্যাপ্ত ঘুম খুবই প্রয়োজনীয়। আমাদের শারীরিক, মানষিক, নিরাপত্তা এবং কুয়ালিটি লাইফের জন্য প্রতিদিনের পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমের কোন বিকল্প নাই। জেগে থাকা অবস্থায় আপনি কেমন বোধ করছেন তা অনেকটাই নির্ভর করে আগের রাতে আপনি কেমন ঘুমিয়েছেন তার উপর। ঘুমের সময় আপনার শরীর কাজ করে যাচ্ছে যার উপর নির্ভর করে আপনার সু-স্বাস্থ্য। শিশু এবং টীনেজারদের স্বাস্থ্যের ডেভেলোপমেন্টের জন্য ঘুম অনেকাংশেই দায়ি। পর্যাপ্ত ঘুম আমাদের কেন প্রয়োজন  তার একটি লিস্ট এখানে দেয়া হল-

  • ♦ পর্যাপ্ত ঘুম আপনাকে করে তুলবে আরও মনোযোগি ও উৎপাদনশীল।
  • ♦ পর্যাপ্ত ঘুম আপনার ওজন বাড়ার ঝুঁকি কমিয়ে দিবে।
  • ♦ পর্যাপ্ত ঘুম ক্ষুধার জন্য দায়ি হরমোনকে প্রভাবিত করে তাই আপনি সঠিক খাদ্য গ্রহনকে নিয়ন্ত্রন করতে সক্ষম হবেন।
  • ♦ পর্যাপ্ত ঘুম আপনাকে যেকোন কাজে দ্রুততার সাথে করার মানষিক শক্তি এনে দিবে তাই আপনার পারফর্মেন্স হবে অসাধারণ।
  • ♦ পর্যাপ্ত ঘুম যে কোন হার্টের অসুখের সভাবনা কমিয়ে দিয়ে আপনাকে রাখবে দুশ্চিন্তা মুক্ত।
  • ♦ পর্যাপ্ত ঘুম আপনাকে রাখবে মানষিকভাবে উৎফুল্ল, তাই সামাজিকতায় আপনি থাকবেন একধাপ এগিয়ে।
  • ♦ খাবার হজমে ঘুম সহায়তা করে থাকে, তাই পর্যাপ্ত ঘুম  আপনার হজম শক্তি বাড়াবে।
  • ইমিউনিটি সিস্টেম বা মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় পর্যাপ্ত ঘুম।
  • ♦ অপর্যাপ্ত ঘুম অধিকাংশ এক্সিডেন্টের মূল কারণ।

আমাদের কার কতটুকু ঘুম প্রয়োজন ?

বয়সের সাথে সাথে আমাদের ঘুমের পরিমাণ কমবেশি চেঞ্জ হয়ে থাকে। এমনকি পর্যাপ্ত ঘুমের পরিমাণ একেক জনের জন্য একেক রকম হতে পারে। আমেরিকান একাডেমি অফ স্লিপ মেডিসিন  (AASM) বয়স অনুযায়ী ঘুমের সময়ের একটি তালিকা তৈরি করেছে যা আপনাদের ঘুমের পরিমাণ নির্ণয়ে সাহায্য করতে পারে। নিচে সেই তালিকা উল্লেখ করা হল।

কত বয়সের মানুষের কতক্ষন ঘুমানো উচিত

  • ♦ ০-৩ মাস বয়স পর্যন্ত- ১৪-১৭ ঘন্টা প্রতিদিন
  • ♦ ৪-১২ মাস বয়স পর্যন্ত- ১২-১৬ ঘন্টা প্রতিদিন
  • ♦ ১-২ বছর বয়স পর্যন্ত ১১-১৪ ঘন্টা প্রতিদিন
  • ♦ ৩-৫ বছর বয়স পর্যন্ত ১০-১৩ ঘন্টা প্রতিদিন
  • ♦ ৬-১২ বছর বয়স পর্যন্ত ৯-১২ ঘন্টা প্রতিদিন
  • ♦ ১৩-১৮ বছর বয়স পর্যন্ত ৮-১০ ঘন্টা প্রতিদিন
  • ♦ ১৮-৬০ বছর বয়স পর্যন্ত ৭-৮ ঘন্টা প্রতিদিন

মনে রাখবেন, আপনি যদি আপনার প্রয়োজনের তুলনায় কম ঘুমান তাহলে তা জমা হতে থাকে। মানে দিনে ১ ঘন্টা করে কম ঘুমালে সপ্তাহে ৭ ঘন্টা জমে যাবে। কিছু মানুষ ঘুমানোর বদলে শুধু চোখ বন্ধ করে রেস্ট নেয় যা আসলে কোন কাজের না। এতে আপনার শরীর কিছুটা বিশ্রাম পেলেও জমানো ঘুম মোটেই কমবেনা।

একটা রুটিন মেনে ঘুমানো উচিত। কেও কেও ছুটির দিনে বেশি রাত জেগে পরের দিন বেশি ঘুমায়, এটা ঠিক নয়। এতে তার ওয়াকিং ডে তে ঘুমের রুটিনকে ব্যহত করে। এমনকি যখনই আমাদের ঘুম আসে তখনই ঘুমিয়ে পরা উচিত, জোর করে জেগে থাকা মোতেই কাজের কাজ নয়, বরং ঘুম আসলে ঘুমিয়ে ঘুম থেকে উঠে আবার কাজে লেগে যাওয়া উচিত। এতে আপনার কাজের পারফর্মেন্স আরও বেড়ে যাবে।

কিভাবে পর্যাপ্ত ঘুমাতে পারবেন ?

আপনাদের কারও যদি ঘুমের সমস্যা থাকে তাহলে নিচের পদক্ষেপগুলো নিয়ে তা কাটানোর চেষ্টা করে দেখতে পারেন।

  • ♦ প্রতিদিন নিয়মিত একই সময়ে ঘুমাতে যান। আপনার দেহকে একটি রুটিনে বাধার চেষ্টা করুন। আপনার শিশুর জন্যও একটি রুটিন করে দিন।
  • ♦ সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও আপনি একই রুটিন মেনে চলুন। এতে আপনার দেহ ঘড়ি ঠিক থাকবে। সরবোচ্চ এক ঘন্টা এদিক ওদিক হতেই পারে।
  • ♦ ঘুমের এক ঘন্টা আগে কৃত্তিম আলো যেমন কম্পিউটার, টিভি কিংবা মোবাইল ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন। এসব আলো আপনার দেহ ঘড়িকে জেগে থাকার সংকেত দেয়।
  • ♦ ঘুমের আগে ভারী খাবার থেকে সাবধান হোন। হালকা খাবার ঠিক আছে। রাতের খাবার ঘুমানোর কয়েক ঘন্টা আগেই সেরে ফেলুন।
  • ♦ মদ, সিগারেট ও অন্যান্য নেশাজাতীয় কিছু্র আভ্যাস থাকলে ত্যাগ করুন। নিকোটিন আর ক্যাফেইন ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায়। এক কাপ কফি ৮ ঘন্টা আপনার শরীরে থেকে যায় যা আপনার ঘুমকে ব্যহত করতে পারে।
  • ♦ প্রতিদিন বাইরে কিছু সময় কাটান যদি সম্ভব হয়, শারীরিক ব্যায়াম করুন।
  • ♦ ঘুমানোর জন্য আপনার ঘরকে প্রস্তুত করুন। যেমন- ঘর যেন হয় নিঃশব্দ, অন্ধকার এবং তাপমাত্রা আপনার অনুকূলে থাকে, বিছানার চাদর পরিস্কার রাখুন।
  • ♦ ঘুমের আগে সম্ভব হলে হালকা উষ্ণ পানিতে গোসল করে নিন।
  • ♦ আপনার ঘুমের সমস্যা থাকলে দিনের বেলা ঝিমাবেন না। এতে রাতের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে। যেকোন সুস্থ মানুষেরো দিনের বেলা ২০ মিনিটের বেশি ঝিমানো উচিত নয়। শিশুদের ক্ষেত্রে এটা ঠিক আছে।
  • ♦ প্রতিদিন হালকা গরম দুধ পানের অভ্যাস করতে পারে। এছাড়া বাদামও ঘুমের সহায়ক ভূমিকা রাখে।
  • ♦ মানসিক অশান্তি, কর্মক্ষেত্রে অসুবিধা ও সেই সংক্রান্ত মানসিক চাপ ঘুমের সমস্যার অন্যতম কারণ। এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করুন।

এরপরেও আপনার ঘুমের সমস্যা থাকতে পারে, দেরি না করে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। ডাক্তারের পরামর্শ নিতে গেলে অবশ্যই পর্যাপ্ত ইনফরমেশন দিয়ে তাকে সহযোগিতা করবেন। এমনকি আপনার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপারও তাকে জানতে দিন। এতে আপনার ঘুমের সমস্যার কারণ বের করতে ডাক্তারের সুবিধা হবে।

আশাকরি আমার এই ব্লগ আপনার দৈনন্দিন জীবনে অনেক কাজে লাগবে। ধন্যবাদ।

Previous articleসুয়েজ খাল খননের ইতিহাস এবং বিশ্বজুড়ে নৌপথে এর গুরুত্ব
Next articleনতুন দশকের শুরুতে বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর ২০টি Heath Tips
যে ব্যর্থ সে অজুহাত দেখায়, যে সফল সে গল্প শোনায়। আমি অজুহাত নয় গল্প শোনাতে ভালবাসি। আসুন কিছু গল্প শুনি, নিজের গল্প অন্যকে শুনাই।